ড. মাহবুব উল্লাহ্:
করোনার অতিমারি গোটা বিশ্বকে ওলটপালট করে দিয়েছে। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, কয়েক দশকেও করোনাভাইরাস বিদায় নেবে না। আমাদের এ ভাইরাসের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। একটা সময় ছিল যখন আমাদের এ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রায় প্রতিবছর বন্যা হতো।
পাকিস্তান আমলের ২৩ বছর এ অঞ্চলের রাজনীতির একটি প্রধান দাবি ছিল, বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। এখানকার বন্যা পরিস্থিতির ওপর ক্রুগ মিশন নামে একদল বিজ্ঞানীর একটি রিপোর্ট সরকারকে দেওয়া হয়েছিল।
বিরোধীদলীয় রাজনীতির অন্যতম দাবি ছিল, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্রুগ মিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্রুগ মিশন মূলত কাঠামোনির্ভর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিল। এ সুপারিশকে অনুসরণ করে নদীর দুই তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দেশের কিছু কিছু অঞ্চলের নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে।
প্রকৃতির সাধারণ নিয়মকে রুদ্ধ করার ফলে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। শুধু পরিবেশ নয়, মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থায়ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এখন আর আগের মতো একসঙ্গে প্রায় দেশজুড়ে বন্যা হয় না। এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন বহুলাংশে দায়ী।
পরিবেশগত বিপর্যয় এড়াতে এখন আর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের দাবি ওঠে না। পরিবেশবাদীদের দাবি এবং কৃষি উৎপাদনের বাস্তবতার ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, আমাদের বন্যার সঙ্গে বাস করতে শিখতে হবে। প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো জোর করে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়।
জাতিসংঘের মহাসচিব যে মন্তব্য করেছেন, তা থেকে আমি যা বুঝতে পারি তা হলো, করোনার এ দুষ্ট ভাইরাসটির সঙ্গে আমাদের নানা আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে জীবনযাপন করতে হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব যে মন্তব্য করেছেন এটি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।
বিশ্বব্যাপী করোনার অতিমারি ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিশ্ব অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি হয়েছে। অনেক উন্নত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে গেছে। বহু কর্মজীবী মানুষ কাজ হারিয়েছে। এর ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। কলকারখানায় উৎপাদনও ব্যাহত হয়েছে।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, ৪-৫ বছরের গবেষণার মাধ্যমেই শুধু একটি ছোঁয়াচে রোগের কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব। কিন্তু এখন মানুষ আশা করছে, এক বছরের মধ্যেই টিকাটি আবিষ্কার হোক এবং এর ব্যবহারও শুরু হোক। এখন বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের জন্য গবেষণা চলছে।
শতাধিক প্রতিষ্ঠান এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যে ৫টি উদ্যোগ টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বলা যায়, চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, একদিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে করোনার টিকা আবিষ্কার হোক, এটাই মানুষের প্রত্যাশা; অন্যদিকে আবিষ্কৃত টিকার ওপর মানুষ আস্থা স্থাপন করতে পারছে না।
অনাস্থার এ মনোভাবের পেছনে যেসব কারণ কাজ করছে তার মধ্যে রয়েছে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া নিয়ে শঙ্কা এবং কী পরিমাণ সময় এসব টিকা মানুষকে সুরক্ষা দেবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা। এ ছাড়া দামের প্রশ্ন তো আছেই। কোনো কোনো টিকার দাম মহার্ঘ হবে।
সাধারণ গরিব মানুষের পক্ষে এ খরচ করা সাধ্যাতীত হয়ে পড়তে পারে। সুতরাং বিশ্ববাসী, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষের পক্ষে টিকার ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে পড়বে। সরকার যদি ভর্তুকি না দেয়, তাহলে অনেক পরিবারই টিকার ব্যয় বহন করতে পারবে না।
টিকা নিয়ে গত পরশু বিভিন্ন দৈনিকে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার ফলে যথেষ্ট উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম আলোর এ সংক্রান্ত শিরোনাম হলো: ‘টিকা নিয়ে হঠাৎ অনিশ্চয়তা’। প্রধান শিরোনামের পর পত্রিকাটিতে আরও যেসব খবর আছে সেগুলো হলো, অক্সফোর্ডের টিকা ভারতের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির খবর নিয়ে মন্ত্রণালয় ও বেক্সিমকোর দুই বক্তব্য।
টিকা আমদানি ও ব্যবহারের অনুমোদন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। পত্রিকাটিতে আরও যেসব উল্লেখযোগ্য সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালার বক্তব্য, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নানের বক্তব্য এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের এমডি নাজমুল হাসানের বক্তব্য।
আদর পুনাওয়ালা বলেছেন, আগামী দুমাসে ভারতে স্থানীয় চাহিদা পূরণের পর রপ্তানির উদ্যোগ নেবে সেরাম ইনস্টিটিউট। স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান বলেছেন, টিকার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে (জি টু জি) চুক্তি আছে। বেক্সিমকোর এমডি নাজমুল হাসান বলেছেন, জিটুজির প্রশ্নই ওঠে না। বাণিজ্যিক চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী টিকা আসবে।
এসব বক্তব্য বিশ্লেষণ করে যা বলা যায় তা হলো, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট মার্চের আগে টিকা সরবরাহ করতে পারবে না। বক্তব্যটি যে ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে তা থেকে এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, মার্চেও বাংলাদেশ টিকাটি পাবে না।
কারণ, তখনো ভারতের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। অন্যদিকে সরকারের স্বাস্থ্য সচিব এবং বেক্সিমকোর এমডির বক্তব্য মারাত্মকভাবে পরস্পরবিরোধী। স্বাস্থ্য সচিব দুই সরকারের মধ্যে (বাংলাদেশ ও ভারত) চুক্তি আছে বলে নিশ্চিত করেছেন। অথচ বেক্সিমকোর এমডি দুই সরকারের মধ্যে চুক্তির বিষয়টি নেই বলে জোরালোভাবে বক্তব্য দিয়েছেন।
বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭০০ কোটি। এই ৭০০ কোটি মানুষের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে টিকা উৎপাদন সম্ভবপর নয়, তা সহজ হিসাবেই বোঝা যায়। ধনী দেশগুলোর টিকা কেনায় অস্থিরতার ফলে দরিদ্র দেশগুলো শুধু পথ চেয়ে বসে আছে। বাংলাদেশ ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে ক্ষুদ্র হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে ক্ষুদ্র নয়। অনুমান করা হয় বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৮ কোটি।
যদি দুই ডোজ করে টিকা দিতে হয় তাহলে বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে ৩৬ কোটি ডোজ টিকা। অথচ মাসে ৫০ মিলিয়নের বেশি টিকা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট সরবরাহ করতে পারবে না। সংবাদপত্রের সূত্রগুলো বলছে, বিশ্বজুড়ে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০টি দেশে করোনার টিকা অনুমোদনের খবর পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ দেশেই ফাইজারের টিকাটি অনুমোদন পেয়েছে।
এ ছাড়া রুশ টিকা স্পুটনিক-ভি অনুমোদন পেয়েছে রাশিয়া, আর্জেন্টিনা ও বেলারুশে। এসব দেশে ডিসেম্বর থেকে টিকা দেওয়াও শুরু হয়ে গেছে। এর উলটো চিত্র অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোয়। এসব দেশে করোনার টিকার প্রতীক্ষা এখনো শেষই হয়নি। কবে পৌঁছাবে টিকা, তার নিশ্চয়তা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।
এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশ দরিদ্র দেশের কাতারে আটকা পড়েছে। ভালো কোনো খবর আসছে না। ডিউক গ্লোবাল হেলথ ইনোভেশন সেন্টারের সূত্রে জানা যায়, বেশ কয়েকটি দেশ ও সংস্থার টিকা কেনার পরিমাণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইইউ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জাপান, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া ও চিলি যথাক্রমে ২০০, ১৬০, ১৫০, ১০০, ৩৬, ৩৫.৭, ২৯, ২০, ১২ ও ৮.৫ কোটি ডোজ টিকা ক্রয় করেছে। অথচ টিকার কেনাবেচা যে শুরু হয়েছে সে খবরও আমরা এতদিন পাইনি।
৪ জানুয়ারি সোমবার দুপুরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুল মান্নান সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, টিকার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের (জি টু জি) মধ্যে চুক্তি আছে। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উপস্থিত ছিলেন।
এর পরই বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যে চুক্তি করেছি, তা দুই দেশের সরকারের মধ্যকার চুক্তি নয়। বেক্সিমকো যে চুক্তি করেছে, তা বাণিজ্যিক চুক্তি।’ একই কথা তিনি সন্ধ্যায় তার বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনেও বলেছেন।
অথচ আমরা জানি গত নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ও বেক্সিমকোর ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। অক্সফোর্ডের টিকা কোভিশিল্ড নামে উৎপাদন করছে সেরাম ইনস্টিটিউট। সেরাম থেকে টিকা এনে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবে বেক্সিমকো।
সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলে আসছেন, জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বা ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে বাংলাদেশে টিকা আসবে। সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালের সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, আগামী ২ মাসে তারা ভারতের টিকার চাহিদা পূরণ করবে।
ভারত সরকারকে প্রাথমিকভাবে ১০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের পরই টিকা রপ্তানি করা সম্ভব হতে পারে। ‘হতে পারে’ বাক্যাংশটি দুশ্চিন্তার অবসান তো করেনি; বরং বাড়িয়ে তুলেছে। এ অনিশ্চয়তা নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ কী পরিমাণ মানসিক চাপের মধ্যে পড়বে তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।
করোনা অতিমারির ফলে গত কয়েক মাসে আমরা ৭ হাজারেরও অধিকসংখ্যক মানুষ হারিয়েছি। এদের মধ্যে সমাজের বহু বিশিষ্টজন রয়েছেন। অনেকেই নিজ ঘরের বাইরে কোথাও যান না। এর ফলে এসব মানুষের মধ্যে যে মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তাতে চিন্তাশীল ও প্রতিভাবান মানুষগুলো সৃজনী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার বিপদে আছেন।
করোনা নিছক শারীরিক সমস্যা নয়, এটি মানসিক স্বাস্থ্যহানিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির কথা বলা হয়েছে, তাতে বেক্সিমকো কী করে ঢুকে পড়ল? যদি কোনো ওষুধ কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, আর অন্য কোনো ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানির সঙ্গে সরকার আলোচনা করেছিল কি না।
এসব ছাড়াও আরও যে প্রশ্ন জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো, ২ ডলারের টিকার জন্য আমাদের সেটা সোয়া ৫ ডলারে কিনতে হবে। ক্রয়মূল্য ও বিক্রয়মূল্যের মাঝে যে ব্যবধান তা কার বা কাদের হাতে যাচ্ছে? হ্যাঁ, কিছু অর্থ পরিবহণ, সংরক্ষণ ও টিকা সেবা পাওয়ার জন্য ব্যয় করতে হবে। তার পরিমাণ কি এত বেশি? দেশবাসীকে পরিষ্কারভাবে হিসাব-নিকাশটা খুলে বলা কি উচিত নয়?
আমজনতার কী করার আছে। যেখানে প্রভাবশালী মহল ঔচিত্যবোধকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে সেখানে কতটুকু বিহিত আশা করা যায়? বাংলাদেশ সেদিনই সত্যিকারের উন্নয়নের পথে পা বাড়াতে সক্ষম হবে, যেদিন এসব প্রশ্ন উত্থাপনের প্রয়োজন হবে না।
ড. মাহ্বুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ